লেখক পরিচিতি:
নামঃ মরহুম মোঃ সিরাজুল ইসলাম সরকার
পিতাঃ সামসুল হক সরকার
(প্রয়াত)
মাতাঃ সুনাইয়া আক্তার
(প্রয়াত)
গ্রামঃ লক্ষীপুরা (সরকার
বাড়ী)
জন্মঃ ১৯৫৫ মৃত্যুঃ ২ জানুয়ারী, ২০১৬ ইং
পেশাঃ শিক্ষক (অবঃ)
উপজেলাঃ আড়াইহাজার, জেলাঃ
নারায়ণগঞ্জ, ২০১৫ খ্রিঃ।
প্রকাশকঃ এইচ এম উসমান
পরিচালক-ইকরা কম্পিউটার এন্ড লার্নিং পয়েন্ট
ঐতিহ্যবাহী
উচিতপুরা বাজারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভূমিকাঃ ইতিহাস হলো কালের সাক্ষী। অতীতের
স্মৃতি নিয়ে ভবিষ্যতের সৃষ্টি। কিভাবে
প্রচীনকালে উচিতপুরা বাজার সৃষ্টি হয়েছিল অনেকেই তা জানেন না, তাই
অজানাকে জানার আগ্রহ সকলেরই থাকে। সেই
পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার প্রবীন, জ্ঞানী, গুণী ও সৎ ব্যক্তিদের সহযোগীতায় এবং আমার একান্ত চেষ্টায়
সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস জানার আগ্রহীদের অনুপ্রেরণায় ঐতিহ্যবাহী উচিতপুরা
বাজারের ইতিহাস সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে আল্লাহ্ চাহেত সক্ষম হয়েছি।
গ্রাম্যবাজার ও হাট গ্রামীন লোকদের জীবনে একটি বিশেষ ভূমিকা বহন করে। গ্রাম্য
লোকদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর জন্য যে দোকান বা প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামীন জীবনের
সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত,
গ্রাম্য হাট-বাজার তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রামের সর্ব শ্রেণীর লোকেরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্রাম্য
হাট-বাজার হতে ক্রয় করতে পারেন।
উচিতপুরা
বাজার প্রতিষ্ঠাতাঃ বৃটিশ থেকে আগত ইংরেজদের সাথে পলাশীর
প্রান্তরে ১৭৫৭ খ্রিঃ বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদৌলার যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মিরজাফরের বিশ্বাস ঘাতাকতার
কারণে নবাব যুদ্ধে হেরে যান, পরে তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে ভারত বর্ষের নিরীহ জনগন ২০০ (দুইশত) বছর
বৃটিশের (ইংরেজ) শাসনাধীন ছিল। বৃটিশ
শাসনের এক বছর পর ১৭৫৮ খ্রিঃ কোন এক
আধ্যাত্মিক দরবেশের আশীর্বাদে ছায়া-শীতল বট-বৃক্ষের নিচে উচিতপুরা বাজার
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমে আধ্যাত্মিক দরবেশের
সম্মানার্থে বট বৃক্ষের ছায়ার নীচে স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিগণ তাঁর জন্য একটি ছোট
কুঁড়ে ঘর নির্মান করেছিল,
দরবেশ এতে খুব খুশী হয়েছিল। পরবর্তীতে বছরের পর বছর, মুলি ও বাঁশ দ্বারা ছোট ছোট বাচারী তৈরী করে নিত্যপ্রয়োজনীয়
বাজার জমানো হয়েছিল। সেই বাজার থেকে আজ
ঐতিহ্যবাহী স্ব-নামধন্য উচিৎপুরা বাজার।
বাজারের
অবস্থানঃ নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলাধীন, উচিতপুরা
ইউনিয়ণে ঐতিহ্যবাহী উচিতপুরা বাজার। এ বাজারে
প্রাচীন ৬টি বিশাল আকারের বট বৃক্ষ ছিল কিন্তু কালের কলগ্রাসে ও বয়সের ভাড়ে
গাছগুলি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বটবৃক্ষ
হাট-বাজারে শীতল বাতাস,
ছায়াদান ও সৌন্দর্য্যবর্ধন করে থাকে। আজ সেই বৃক্ষগুলি না থাকায় বাজারের আসল রূপটা যেন অনেকটা মলিন হয়ে গিয়েছে।
উল্লেখ্য নদীর ভাঙ্গন থেকে
বাজার রক্ষার্থে ১৯৪৫ খ্রিঃ সিমেন্ট বিহীন ইটা সুরকি দ্বারা নির্মিত পাকা অসপন্ন
দেয়ালের অংশ বর্তমানেও মাটির তলায় ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রহিয়াছে। ২০০২ খ্রিঃ নির্মিত বাজারের পূর্ব প্রান্তে দর্শনীয় একটি বড়
পাকা ঘাটলা আছে, তা দেখে মনে হয় যেন মিনি নদী বন্দর।
বাজার
সংলগ্ন নদীর গতিপথঃ উচিতপুরা বাজারের ছোট নদীটি বিষনন্দী ইউনিয়ণের
মেঘনার মোহনা হতে আরম্ভ হয়ে গোপালদী বাজার, রামচন্দ্রদী বাজার, উচিতপুরা
বাজার, জাঙ্গালিয়া বাজার,
চম্পকনগর বাজার ও শান্তির বাজার হইয়া বারদী পর্যন্ত মেঘনার ¯্রােতে
মিলিত হয়েছে। শুকনা মৌসুমে অনেকাংশে এই নদী
শুকাইয়া যায়, যার প্রেক্ষিতে শতশত কৃষকদের ইরি সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। অন্য দিকে নৌকা মাঝি ও ট্রলার মালিকগণ আয়-রোজগার হইতে
বঞ্চিত হন।
বৃটিশ
আমলের বাজারঃ উচিতপুরা বাজার বটতলায় মুলির ছই-ছাউনি ছোট ছোট বাচারি ঘর
ছিল তৎকালিন দোকান। বৃটিশ আমলে ছায়া শীতল বটতলায়
সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার বিকালে হাট বসিত। দোকানঘর
তেমন উন্নত ছিল না,
মাল পত্র ও পরিপূর্ণ ছিল না। বট তলায় নদীর পাড়ে চাল,
পাট,
আলু,
বাঙ্গি, ক্ষিরা, তরমুজ, কাঁঠাল, আটা, গুঁড় ও
ইক্ষু ইত্যাদি অত্র হাটে বেশি পাওয়া যেত। আড়াইহাজার
থানার দূর-দূরান্ত গ্রাম থেকে ঘোড়া পরিবহনে মালামাল আসা-যাওয়া করেছিল। ঐ যুগে
কাঁচা-পাকা কোন সড়ক পথ ছিল না, মাঠের সরু পথ দিয়ে যার যার গন্তব্য স্থানে পৌছিয়া ছিল। বৃটিশ আমলে উচিতপুরা হাটে চাল, আলু, বাঙ্গি, ক্ষিরা, তরমুজ, গুঁড়, ছোট-বড়
সকল প্রকার মাছ ও তরকারীর জন্য বিখ্যাত ছিল।
বাংলা নববর্ষে চৈত্রসংক্রান্তিতে অষ্ট তালের বাজনা বাজিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়
বাজারের বট তলায় পরব (এক প্রকার মেলা) জমানো হইত। মেলায় শিশুদের খেলার পুঁতুল, খই-বিন্নি, বাতাসা, মিঠাই, মন্ডা, লাড়–, সন্দেশ, নানা
রঙ্গের বেলুন ও বাঁশি ইত্যাদি সুলভ মূল্যে পাওয়া যেত। পরিশেষে ঠাকুর মশাই পাঠা বলি দিয়ে পূজাপর্ব সমাপ্ত করতেন। এলাকার শিশুদের আনন্দদানে রাতে হইতো রঙ্গিন পুঁতুল নাচ।
বাজারের
সীমানাঃ উচিতপুরা বাজারের উত্তরে আগুয়ান্দী পশ্চিমপাড়া ও হাজী
বেলায়েত হোসেন ডিগ্রী কলেজ। দক্ষিনে
নদীর ওপর ১০০ মি: পাকা সেত (এনামূল হক স্মৃতি সেতু), লক্ষীপুরা, শম্ভুপুরা, শোভারামপুর
ও মোহনপুর গ্রাম। পূর্বে আগুয়ান্দী, বিজয়নগর, ও গহরদী গ্রাম। পশ্চিমে উচিতপুরা, রায়পুরা, আলীসাদী
ও কাদিরদিয়া গ্রাম।
বৃটিশ আমলে জমিদারদের
অধীনে উচিতপুরা বাজারঃ বৃটিশ আমলে পূর্ব বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায় ধনী ও প্রতাপশালী
ছিল। যার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার
বিভিন্ন এলাকায় ভাগকরে বিত্বশালী হিন্দু জমিদারদের হাতে স্থানীয় ক্ষমতা প্রদান
করেছিল। বৃটিশ (ইংরেজ) শাসনের অন্যতম
বৈশিষ্ট্য ছিল “ভাগ কর ও শাসন কর নীতি”।
ইংরেজ সরকারের আমলে দুইজন প্রতাপশালী জমিদার উচিতপুরা বাজার এলাকায় নিয়োগ করা
হয়েছিল। (১) প্রয়াত শ্রী দেবচন্দ্র লাহরী ও
(২) প্রয়াত শ্রী কনক চন্দ্র লাহরী, তাঁদের গ্রাম ছিল সদাসদী, বর্তমানে
গোপালদী পৌরসভা, আর প্রাচীন নাম ছিল মেরাতলী।
তৎকালীন জমিদারদের বিশ্বস্ত নায়েব ছিল খাগকান্দা ইউনিয়নের আড়াইহাজার থানাধীন
লক্ষীপুরা (সরকার বাড়ী) রহিম বক্স সরকার। তিনি
প্রায় ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) বছর জমিদারষ্ট্রেটের নায়েব ছিল। তাঁর প্রয়াতের পর অত্র বাড়ির প্রয়াত আকবর আলী সরকারের বড় পুত্র প্রয়াত মোঃ
সামসুল হক সরকার ও চৈতনকান্দা গ্রামের প্রয়াত মোঃ সাইজুদ্দিন সরকার ওরফে
(ব্যাঙ্গু) সরকার জমিদারদের বিশ্বস্ত নায়েব (বর্তমানে যাহা ভূমি উপ-সহকারী
কর্মকর্তা) হয়েছিলেন। তাঁরা মাত্র ৭ (সাত) বছর
চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন।
নায়েবদের সাহায্যকারী লাল
পাগড়ী ওয়ালা কয়েকজন পেয়াদা ছিল। নায়েবগণ
তাদের সাহায্যে এলাকার কর আদায় করতেন। মাত্র ৩
বছর জমির কৃষিকর বাকি থাকলে স্বয়ং জমিদার তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে কৃষকের তাজা
পাট ক্ষেত কেটে ধ্বংশ করে দিতেন। কারণ পাট
ছিল ঐ যুগের অর্থকরী ফসল। হায়! হায়! কৃষক-কৃষাণীদের
কি হৃদয় বিদারক বুক ফাটা কাঁন্নাকাটি। এ দৃশ্য
যারা ঐ কালে দেখেছেন তারাই বুঝতে পেরেছেন বৃটিশ পরিচালিত জমিদারদের অত্যাচার ও
জুলুমের মাত্রা যে কত নিষ্ঠুর ছিল। শুধু তাই
নয়, ইংরেজদের নীল কারখানায় এদেশের শ্রমিক বিনা টাকায় কাজ করাতেন। আর সারদিন ক্ষুদা পেটে বিদায় দিতেন। কালক্রমে করুনাময়ের কৃপায় মতান্তরে ১৯৫১ খ্রিঃ এদেশ থেকে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে শতশত হিন্দু ও
মুসলমান উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ চাকুরী বঞ্চিত হলেও কৃষকগণ বেঁচে গেলেন এবং
জমিদারদের অত্যাচার হইতে চিরতরে মুক্তি পেলেন।
বাজার
সরকারি টেন্ডার (ডাক)ঃ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর
১৯৫১ খ্রিঃ নারায়ণগঞ্জ এস.ডি.ও অফিসে হাটের ডাক হলে, বাজার সংলগ্ন বাড়ি প্রয়াত শ্রী
ভারত দাশের পুত্র প্রয়াত বরদাকান্ত দাশ (রেনু) ডাকে প্রথম হয়ে, উচিতপুরা
হাটের ইজারাদারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। রেনু
বাবু ৫ বছর উচিৎপুরা হাটের ইজারাদার ছিল। তাঁর
প্রয়াতের পর পুনরায় এলাকার প্রভাবশালী মুসলমান ব্যক্তিগণ প্রতিবছর হাটের ডাক পাইয়া
থাকিতেন। চলমান ২০১৫ খ্রিঃ উচিতপুরা হাটের
ডাক পাইয়াছেন মোঃ রতন মিয়া (ইব্রাহিম) পিতাঃ হাজী মোঃ মান্নান (প্রাক্তন মেম্বার)
গ্রামঃ আগুয়ান্দী,
উপজেলাঃ আড়াইহাজার।
নিত্য
বাজারের বর্ণনাঃ প্রতিদিন সকাল ৭ টায় বাজার বসে সকাল ১১টা
পর্যন্ত বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছু বিক্রয় হয়। দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, সামুদ্রিক শুটকি ও বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি, তাছাড়া চাল, ডাল, লবন, মরিচ, পেঁয়াজ, হলুদ, আঁদা, রসুন ও
তেল ইত্যাদি পাওয়া যায়। অন্যদিকে চা-নাস্তা, দই-মিষ্টি, রুটি, বিস্কুট, পিঠা ও
পান শুপারি পাওয়া যায়। বাজারের সকল প্রকার দোকানে
এবং ঔষধের ফার্ম্মেসী গুলিতেও বেশ বেচা-কেনা হয়ে থাকে। বরিশালী কাঠের দোকনগুলিতে প্রচুর পরিমানে কাঠ বিক্রয় হয় এবং অন্যদিকে জ্বালানী
হিসেবে লাকড়ি বিক্রয় ও কম নয়। হার্ডওয়ার্ডের
যাবতীয় মালামাল, সার, কিটনাষকও যথেষ্ঠ পরিমানে বিক্রয় হয়। বাজারের
কলেজ রোডে বেবী ও সি.এন.জি ষ্টেশন, এখানে একটি বিখ্যাত গাড়ির তেল, মবিল ও
পেট্রোল বিক্রয়ের দোকান আছে। অত্র
রোডে সুপরিচিত একমাত্র যমুনা ফ্রিজ, টিভি ও এয়ারবেইস ট্রাভেলস্ ইত্যাদি বিক্রয় কেন্দ্র এবং একটি কম্পিউটার
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। ফটোষ্টেট, ষ্টুডিও
এবং পার্লারও সর্বদা কর্মচঞ্চল থাকে। বর্তমানে
চায়নিজ হোটেল ও রুটি বিস্কুটের বেকারী চালু হয়েছে।
বাজারের
সেট ও মার্কেটঃ বাজারে আধাপাকা ৬টি সেট আছে। যেমনঃ- মাছের সেট, মাংসের সেট, শুটকির
সেট, তরকারি সেট, দুধের সেট, কাপড়ের সেট। বাজারের সময় বিক্রেতা ও ক্রেতায়
পরিপূর্ণ হলে সেট গুলি দেখিতে খুব আকর্ষণীয় দৃশ্যে পরিনত হয়। বাজারে বর্তমানে প্রায় ছোট-বড় ৩০টি মার্কেট আছে, আরও মার্কেট হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা
রয়েছে। মার্কেট গুলিতে সকাল ৭টা থেকে রাত
১০টা পর্যন্ত বেচা কেনা হয়ে থাকে।
হাটের
বর্ণনাঃ গ্রাম বাংলার গ্রাম্য হাট মানুষের জীবনে একটি বিশেষ ভূমিকা
বহন করে। গ্রাম্য নিত্য বাজারে যাহা না পায়
তা হাট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় করে থাকে। উচিতপুরা হাট সপ্তাহে দুই দিন শনি ও মঙ্গলবার বসে থাকে। হাটে স্থায়ী,
অস্থায়ী, ফুটপাত ও ভাসমান অনেক প্রকার দোকান মালামাল দিয়ে সাজিয়ে
রাখেন। হাটের দৃশ্য খুবই সুন্দর, যদি
আবহাওয়া খারাপ না হয়। বর্তমানে হাটে সবমিলে
প্রায় ৪০০ (চারশত) দোকান খুলে বসে। হাটের
ইজারাদার সু-শৃঙ্খলভাবে হাটকে ভাগ করে দিয়েছেন। অস্থায়ী, ভাসমান ও ফুটপাত ইত্যাদি দোকান থেকে হাটের খাজনা তারা যথা নিয়মে আদায় করে
থাকেন।
বর্তমানে
উচিৎপুরা বাজারঃ ১৯৭১ খ্রিঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে
বাজারের পটভূমিকা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ
করে বিশ্ব বিখ্যাত,
বাংলাদেশের গৌরব নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ডঃ ইউনুস সাহেব
উচিতপুরা বাজারের পার্শে¦
০৮-০৫
১৯৮৮ খ্রিঃ গ্রামীন ব্যাংক উচিতপুরা শাখা এবং ১৯৯৩ খ্রিঃ
গ্রামীন কল্যাণ, উচিতপুরা স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করে বাজার এলাকার জনসেবার সুযোগ করে
দিয়েছেন। বাজারের ৫-৬টি বিখ্যাত গলি আছে, কিছু গলি
পাকা ও কয়েকটি ইটা বিছানো। পাকা
রাস্তাগুলি থাকায় রাস্তার দুই পার্শ্বে
নতুন নতুন মার্কেট গড়ে উঠেছে এবং নানা প্রকারের দোকান আলোক সজ্জিত করে
মালা-মাল দ্বারা পরিপূর্ণ রেখেছেন, যা কিনা দূর-দূরান্ত ক্রেতাদের
দৃষ্টি আকর্ষন করে।
বাজারে
বরিশালের কাঠ ব্যবসায়ীঃ ১৯৮৮ খ্রিঃ বন্যার পর বরিশাল থেকে আগত
মোঃ মজনু খান ও তার পার্টনার মোঃ সাইফুল ইসলাম, তাদের ঠিকানা নেছারাবাদ, উপজেলাঃ
স্বরুপকাঠি, জেলাঃ বরিশাল। এই দুই ব্যবসায়ী সর্ব প্রথম
উচিতপুরা বাজারে ঘর ভাড়া নিয়া কাঠ ও ‘ছ’-মিলস্ ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। দিনদিন তাদের ব্যবসায় উন্নতি হলে, বরিশালী
অনেক পারদর্শী সৎ কাঠ ব্যবসায়ী নদী পাড়ে কাঠের ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। স্থানীয় মেম্বার ও সচেতন ব্যক্তিগণের প্রচেষ্ঠায় বর্তমানে
২৫টি কাঠের দোকান এবং ৭টি ‘ছ’ মিলস্ চালু রয়েছে এবং বহু শ্রমিক কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেছে। ভবিষ্যতে আরোও ‘ছ’ মিলস্ এবং কাঠের দোকান হওয়ার
যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে কাঠের
দোকানগুলিতে মেহগনি,
গর্জন, রেন্ডি, টিক চাম্বুল, গামারী, সেগুন, লোহা, শাল, কড়ই, আম, জাম, নিম, কাঁঠাল, জারুল
ইত্যাদি ও দেশী-বিদেশী সর্বপ্রকার কাঠ এখানে সুলভ মুল্যে পাওয়া যায়। এক কথায় বর্তমানে কাঠ ও ফার্নিচারের জন্য উচিতপুরা বাজার
অত্র আড়াইহাজার উপজেলায় বিখ্যাত।
বাজারের
খেলাধুলাঃ খেলার মধ্যে নিহীত চিত্তবিনোদন এবং জাতীয় আশা আকাঙ্খার
প্রতিফলন। অনেকে খেলাধুলাকে মনে করে “ঘরের ভাত খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” এরূপ মনে করা বাঞ্চনীয় নয়। উচিতপুরা বাজারে অতীত কালে জাতীয় খেলা কাবাডি বট বৃক্ষের
নিচে হাজার হাজার দর্শকের সম্মুখে অনুষ্ঠিত হইতো। তাছাড়াও হাডুডু,
দাড়িয়া বাঁধা, গোল্লাছুট, নদীতে
সাঁতার প্রতিযোগীতা ও নানা রঙ্গের নৌকা বাইচ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হইতো এবং দর্শকগণ
করতালির মাধ্যমে বিপুল আনন্দ লাভ করিতেন। বর্তমান
যুগে শিশু, যুবক, যুবতী ক্রীকেট,
হকি,
টেনিস, ফুটবল কেরাতী ও কুস্তি সহ বিদেশী খেলায় পারদর্শী।
বাজারের
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানঃ
অতীতকালে একতারা,
দোতারা, জারি, সারি, পালাগান, পুঁথি, পল্লীগীতি ও লালন গীতি ইত্যাদি গান বাজনা হইতো। গান বাজনা ছাড়াও নাটকে অত্র উপজেলায় উচিতপুরা বাজার যথেষ্ঠ
সু-নাম ছিল। আজও এ অঞ্চলের মানুষ নবাব
সিরাজউদ্দৌলার নাটকের অভিনয় ভুলিতে পারেন নাই। বাজারের বিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রয়াত কমুর উদ্দিন ও রমিজ উদ্দিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা
ও মিরজাফরের অপূর্ব পাঠ করে দর্শকের অকুণ্ঠ প্রসংশা লাভ করেছিলেন। এ নাটকের পরও আরও
অনেক নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবার
কখনো রূপবান, সাগর বাদশা ইত্যাদি যাত্রাগান দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজার হাজার শ্রোতা সারা
রাত জেগে থেকে গান শুনিত এবং অনাবিল আনন্দ-উপভোগ করিত। কোন কোন সময় সরকার বিনা পয়সায় বায়োস্কপ দেখাতো। কালের প্রবাহে সব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। রাতের
পুঁতুল নাচে শিশুরা কত যে মুগ্ধ হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বাজারে
বা হাটে গাজী কালুর “ছবি প্রদর্শন” করিয়া পরিচালক কাহিনী অনর্গল
বলিতেন মাত্র দুই আনা পয়সার বিনিময়ে। অতীতের
স্মৃতিগুলো হৃদয় থেকে ভুলা যায় না।
উচিৎপুরা
বাজারে নৌ ও স্থল পথে যাতায়াতঃ নদী পথে উচিতপুরা বাজার টু বিশনন্দী ফেরী ঘাট, কালাপাহাড়িয়া
ও উচিতপুরা বাজার টু নারায়ণগঞ্জ। অতীতকালে
নদী পথে নৌকা, গয়না (ছইওয়ালা বড় নৌকা) ও লঞ্চ চলিত। লঞ্চগুলি
ছিল লংলা, মদিনা, অমরিকা, জলরাণী, শেফালী, আল-আমিন, নূর, গোপালদী, আয়ুব, নাজমুল-১ ও নাজমুল-২ ইত্যাদি। ১৯৮৬
খ্রিঃ হতে নদী পথে চালু হয় অসংখ্য ট্রলার। বর্ষাকালে
ট্রলার ও নৌকা চলে। শীত মৌসুমে নদী অনাব্যতার কারণে
শুকাইয়া যায়, যার প্রেক্ষিতে নদীতে কোন যানবাহন চলিতে পারে না। স্থল পথে উচিতপুরা বাজার হতে একটি পাকা রাস্তা পশ্চিম দিকে শান্তির বাজার
পর্যন্ত, পূর্ব দিকে একটি পাকা রাস্তা গোপালদী
পৌরসভা ও বিশনন্দী মেঘনা ফেরী ঘাট পর্যন্ত। উত্তরে একটি পাকা রাস্তা আড়াইহাজার পৌরসভা পর্যন্ত ও দক্ষিনে একটি পাকা রাস্তা
খাগকান্দা মেঘনা ঘাট পুলিশ ফাঁড়ী পর্যন্ত গিয়াছে। অত্র পাকা রাস্তাগুলি দিয়ে সি.এন.জি, বেবী, অটোরিকশা, পা-চালিত
রিকশা, ভ্যান, করিমন ও নসিমন ইত্যাদি যানবাহন চলে।
বাজারের
মসজিদ ও চারদিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ ১৯৪৮ খ্রিঃ
মসজিদ চালাঘর, ১৯৯৪ খ্রিঃ পাকাকরণ ও ২০১২ খ্রিঃ বিখ্যাত মসজিদ পুণঃনির্মান করে ছিল। মানব সভ্যতার প্রথম ধাপ হল শিক্ষা, তাই
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ব্যতিত কোন গ্রাম, শহর, নগর ও
বাজার ইত্যাদি উন্নয়ণ সম্ভব নয়। ঐতিহ্যবাহী
উচিৎপুরা বাজারের অনতি দূরে চারদিকে রয়েছে, পাঁচটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি
উচ্চ বিদ্যালয়, একটি ডিগ্রী কলেজ,
পাঁচটি মাদ্রাসা, তিনটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল, একটি
কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র ও প্রায় ২৫টি মক্তব। শিক্ষার হার শতকরা ৬৫ ভাগ। উচিতপুরা বাজার একটি গ্রোথ সেন্টার। বাজার
উন্নয়ণ মানে এলাকার উন্নয়ণ। বাজার
উন্নয়ণের চাবিকাঠি হলো সৎ ব্যবসায়ী, বাজারের “কার্য্যকরী পর্ষদ” ও সুষ্ঠ প্রশাসন।
ঐতিহ্যবাহী উচিতপুরা বাজার
“নগর কেন্দ্রে” উন্নয়ণ হওয়ার
সম্ভাবনা রয়েছে, সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
(প্রকাশকের কথাঃ জনাব মরহুম
সিরাজুল ইসলাম সরকার একজন লেখক, গবেষক ও শিক্ষা প্রিয় বেক্তি ছিলেন। উচিতপুরা
বাজারে অত্যাধুনিক কম্পিউটার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “ইকরা কম্পিউটার এন্ড লার্নিং
পয়েন্ট”
প্রতিষ্ঠার শুরু লগ্নে সিরাজ স্যার এর ভমিকা ছিল অসামান্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে তার
লিখিত পান্ডুলিপিগুলু কম্পুজ করার কাজ ইকরা কম্পিউটার থেকেই করিয়ে নিতেন। আমরা তার
মাগফেরাত কামনা করি।)